বিদ্যুতের দাম ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ

বিদ্যুতের দাম ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ

বিদ্যুতের দাম ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ
বিদ্যুতের দাম ৫৮ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ

অনলাইন ডেস্ক: বিদ্যুতের পাইকারি দাম বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি। তবে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের দাম পিডিবির প্রস্তাবিত মূল্যহার ৮ টাকা ৫৬ পয়সা থেকে কমিয়ে কমিটি ৮ টাকা ১৬ পয়সা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে। অর্থাত্ বিদ্যমান দর ৫ টাকা ১৭ পয়সা থেকে প্রায় ৫৮ শতাংশ দামবৃদ্ধির সুপারিশ করা হলো। এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি হারে দামবৃদ্ধির সুপারিশ। তবে সরকার ভর্তুকি দিলে বা যে পরিমাণে ও হারে ভর্তুকি দেবে তা বিবেচনায় নিয়ে বিইআরসি চূড়ান্ত মূল্যহার ঘোষণা করবে।

সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার বিদ্যুতের পাইকারি এবং খুচরা দাম একসঙ্গে বাড়ায়। তখন প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের সরবরাহ মূল্য ৫ টাকা ৬৪ পয়সা নির্ধারণ করা হলেও পাইকারি দাম ৫ টাকা ১৭ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। অর্থাত্ প্রতি কিলোওয়াটে সরকার ৪৭ পয়সা ভর্তুকি দেয়। দামবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় আট দশমিক ৪ শতাংশ। পাইকারি বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি মূল্য ৪০ পয়সা বৃদ্ধি পায়। অথচ গতকালের শুনানিতে উপস্থাপিত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের পাইকারি দাম বিদ্যমান দর থেকে ৬৫.৫৭ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ টাকা ৫৬ পয়সা নির্ধারণ করার প্রস্তাব দিয়েছে পিডিবি। বিপরীতে এটি ৫৭.৮৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ টাকা ১৬ পয়সা নির্ধারণের সুপারিশ করেছে বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি।

মূল্যায়ন কমিটির হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮ হাজার ১৯৪ কোটি ৯০ লাখ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা-কোম্পানিগুলোর কাছে সরবরাহ করতে হবে পিডিবিকে। এ জন্য এক বছরে পিডিবির দরকার হবে ৬৬ হাজার ৮৩৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এ দামের মধ্যে সরকারের বিভিন্ন কর এবং বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন তহবিলের টাকাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। মূল্যায়ন কমিটির বক্তব্যের সারাংশ হলো- বিদ্যমান দরে বিদ্যুৎ বিক্রি করা হলে এক বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতি থাকবে। ঘাটতি না রাখতে হলে পিডিবিকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ৮ টাকা ১৬ পয়সায় বিক্রি করতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে সরকার ভর্তুকি দিলে পাইকারি মূল্যহার কমবে। যে হারে ভর্তুকি দেবে সে হারে মূল্যহার কমবে। তবে সরকার ভর্তুকি দেবে কি দেবে না তা নিয়ে শুনানিতে তথ্য উপস্থাপন করেনি বিইআরসি। কমিশনের চূড়ান্ত ঘোষণায় এ সংক্রান্ত আদেশ দেওয়া হবে। তবে কারিগরি কমিটি মনে করে, ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুতের খুচরা দাম না বাড়িয়ে পাইকারি দাম কার্যকর করা সম্ভব হবে না।

এদিকে পিডিবির প্রস্তাব এবং বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশে নানা অসঙ্গতি ও অসম্পূর্ণ তথ্য চিহ্নিত করে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানো কোনো সমাধান নয়। দামবৃদ্ধি যৌক্তিক ও ন্যায্য হবে না। বরং অপচয়, সিস্টেম লস এবং সরকারের করের পরিমাণ কমিয়ে এবং দুর্নীতি দূর করে গ্রাহককে সহনীয় এবং ন্যায্য দরে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যায়। তিনি নানা প্রশ্ন ও জেরাশেষে ক্যাবের পক্ষে সুপারিশ তুলে ধরে বলেন, পাইকারি বিদ্যুতের প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি সমন্বয়ে মূল্যহার বৃদ্ধি বা ভর্তুকি প্রদান করতে হবে না। বরং অন্যায়, অযৌক্তিক ও লুন্ঠনমূলক ব্যয়বৃদ্ধি বন্ধ করলেই চলবে। সরকার ৬ শতাংশ ট্যাক্স নতুনভাবে আরোপ না করে, জ্বালানি তেলে শুল্ক-কর অব্যাহতি সুবিধা পুনর্বহাল করে, কয়লার ওপর ৫ শতাংশ নতুনভাবে আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহার করে এবং বিদ্যুৎ উত্পাদনে ব্যবহৃত তেল ব্যক্তি খাতের পরিবর্তে বিপিসির মাধ্যমে আমদানি করে মোট ৮ হাজার ৮৮৩ কোটি টাকা ঘাটতি কমানো যাবে। এর সঙ্গে ক. অবৈধভাবে নির্ধারিত ডিজেল ও ফার্নেস তেলের বর্ধিত দাম এবং কুইক রেন্টালের বিদ্যুৎ অবৈধভাবে ক্রয়কৃত মূল্য পাইকারি বিদ্যুতের মূল্যহারে সমন্বয় না করে ঘাটতি ১৪ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা, খ. পিডিবির কম্বাইন্ড সাইকেল বিদু্যত্কেন্দ্রগুলো ৫৩ শতাংশের পরিবর্তে ৬৭ শতাংশ পিএফ-এ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে ঘাটতি ১৫ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা, গ. ১৩২ কেভি ও এর বেশি ভোল্টেজ লেভেলের ভোক্তাদের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার ভর্তুকিমুক্ত করে এবং বিতরণ সংস্হাভেদে তা অভিন্ন করে ঘাটতি ১ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা, এবং ঘ. ১৯টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ক্ষেত্রে পাইকারি দাম যৌক্তিক করে ঘাটতি ৩ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা কমানোর প্রস্তাব করেন অধ্যাপক এম শামসুল আলম। এ প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করা হলে পাইকারি বিদ্যুতে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি সমন্বয়ের পর ৩ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে। অর্থাত্ বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হবে না। বরং কিছুটা কমানো যাবে।

শুনানিতে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সংগঠনটির সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু। তিনি বিভিন্ন প্রস্তাব-সুপারিশ-দাবি তুলে ধরে বলেন, অর্থনৈতিক প্রভাব যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করে বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়নি। ফলে এই আবেদন অযৌক্তিক। বর্তমান চলমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আলোচ্য প্রেক্ষাপটে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি সরকারের একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ অবস্থায় মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব গ্রহণ না করার আহবান জানান তিনি।

বিতরণ সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিদ্যুতের পাইকারি দাম বাড়ানো হলে তা গ্রাহকদের কাছ থেকে নিয়েই পরিশোধ করতে হবে। তাই স্বাভাবিকভাবেই খুচরা দাম বাড়াতে হবে। তবে এখনও তারা খুচরা দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দেননি।

বিইআরসির চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বলেন, আইনি প্রক্রিয়ার কারণে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি নেওয়া হচ্ছে। পাইকারি দাম ঘোষণা হলে খুচরার ওপর প্রভাব পড়বে। এ নিয়ে তাদের কোনো প্রস্তাব আমরা পাইনি। তিনি বলেন, প্রশ্ন উঠতে পারে গ্যাসের দামের গণশুনানির ঘোষণা না দিয়ে কেন আমরা বিদ্যুতের দামের শুনানি নিচ্ছি। আপনারা জানেন, দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয় থাকে, সেটি দালিলিকভাবে প্রমাণের বিষয় থাকে। সেটার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এটা শেষ হলে গ্যাসের দামের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে। উল্লেখ্য, সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি ইউনিট (কিলোওয়াট) বিদ্যুতের পাইকারি দাম গড়ে ৪০ পয়সা এবং খুচরা ৩৬ পয়সা বাড়ানোর আদেশ দেয় বিইআরসি।

মতিহার বার্তা/এমআরটি

খবরটি শেয়ার করুন..

Leave a Reply